জনজীবন ডেস্ক—-
মুঘল শাসকের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মারক ঐতিহ্যবাহী আন্দরকিলা শাহি জামে মসজিদ। চট্টগ্রামের অনন্য এক ঐতিহাসিক স্থাপনা এ মসজিদ। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনি। সাড়ে তিনশ বছরের পুরনো এই মসজিদটি যেন ধর্ম আর ইতিহাসের সম্মিলিত পাঠ। এটি মুঘল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উঁচুতে পাহাড়ের ওপর এর অবস্থান। মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৫৪ ফুট আর প্রস্থ প্রায় ২২ ফুট। প্রতিটি দেয়াল প্রায় আড়াই গজ পুরু। পশ্চিমের দেয়াল পোড়ামাটির তৈরি। বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের। মধ্যভাগে একটি বড় এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত। ১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভুজাকৃতির বুরুজগুলোর মধ্যে পেছন দিকের দুটি এখনো আছে। পূর্বে তিনটি, উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদটিতে তিনটি মিহরাব থাকলেও এখন মাঝের সবচেয়ে বড়টাই ব্যবহার হচ্ছে।
মূল ইমারতের প্রবেশ পথে কালো পাথরে খোদাই করা সাদা অক্ষরের লেখা ফারসি লিপিতে চোখ আটকে যাবে যে কারও। ওই লেখার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগদ্বাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হলো।’ উইকিপিডিয়া থেকে জানা যায়, চট্টগ্রামের আন্দরকিলার সঙ্গে মুঘলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনি সম্পর্কিত। এই কেলায় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ সালের ২৭ জানুয়ারি শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এই আন্দরকিলার অন্দরে বা ভেতরে প্রবেশ করলে এর নাম হয়ে যায় ‘আন্দরকিলা’। চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ সালে এখানে নির্মাণ করেন ‘আন্দরকিলা শাহি জামে মসজিদ।’
মসজিদটির নকশার সঙ্গে দিলির ঐতিহাসিক জামে মসজিদের অনেক মিল রয়েছে। দিলি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত বলে এই মসজিদকে পাথরের মসজিদও বলা হয়। বুজুর্গ উমেদ খাঁ কর্তৃক মসজিদটি নির্মাণ হওয়ার পর থেকেই চট্টগ্রামের ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের আকর্ষণের কেন্দ্র হয়ে ওঠে এটি। মসজিদের ইমাম-খতিব নিযুক্ত হন পবিত্র মদিনা শরিফ বিশেষ করে রাসুল (সা.)-এর বংশধর থেকে। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
তবে মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের সময়ে (১৭১৯-১৭৪৮ খ্রি.) চট্টগ্রামের নবাব ইয়াসিন খান আন্দরকিলা মসজিদের অদূরে রহমতগঞ্জে কদম মোবারক নামে আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ওটার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি সম্পত্তিও দান করেন। এ ছাড়া ওই মসজিদের পাশের একটি কক্ষে নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কদম মোবারকের ছাপ-সংবলিত একটি পাথর সৌদি আরব থেকে সংগ্রহ করে স্থাপন করেন। ফলে মসজিদটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য হয়ে ওঠে আরও আকর্ষণীয়। এক সময় মুসলিরা ইয়াসিন খানের মসজিদের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকলে বুজুর্গ উমেদ খাঁর মসজিদটি ক্রমে সংস্কারবিহীন অবস্থায় পড়ে থাকে। এ অবস্থায় ১৭৬১ সালে নবাব মীর কাসিম বর্ধমান মেদিনীপুর জেলাসহ চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে ছেড়ে দেন। ইংরেজরা চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার পর আন্দরকিলা মসজিদটিকে অস্ত্রাগারে পরিণত করে। ১৮৮৫ সালে হামিদুলাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মসজিদটি মুসলমানদের ব্যবহারের জন্য আবারও খুলে দেওয়া হয়।
১৯২০ সালে প্রকাশিত চৌধুরী পূর্ণচন্দ্র দেব বর্মণের লেখা চট্টগ্রামের ইতিহাস বইটিতে বলা হয়েছে, হামিদুলাহ খাঁ ছিলেন চট্টগ্রামের একজন বড় জমিদার। ১৮৪২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন চট্টগ্রাম শাসন করছিল, তখন তিনি এ অঞ্চলের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন। এখন এই মসজিদে প্রতি ওয়াক্তে অন্তত আড়াই থেকে তিন হাজার মুসলি নামাজ আদায় করেন। শুক্রবার জুমায় তা ছাড়িয়ে যায় পাঁচ হাজারে।
Leave a Reply