1. kabir28journal@yahoo.com : Abubakar Siddik : Abubakar Siddik
  2. kabir.news@gmail.com : Kabir :
মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:৩৩ পূর্বাহ্ন

সাংবাদিকের নাম:
  • আপডেট টাইম: মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০২৪
  • ৬৭ ০০০ জন পড়েছে।

কাজী নজরুল ইসলামের পাঁচটি বিখ্যাত কবিতা

  সাহিত্য ডেস্ক——

বিদ্রোহী

বল বীর – বল উন্নত মম শির! শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির! বল বীর – বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া, উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর! মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর! বল বীর – আমি চির উন্নত শির!

আমি চিরদূর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস, মহা- প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস! আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার, আমি ভেঙে করি সব চুরমার! আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল! আমি মানি না কো কোন আইন, আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন! আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাতৃর! বল বীর – চির-উন্নত মম শির!

আমি ঝন্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথ-সমূখে যাহা পাই যাই চূর্ণি’। আমি নৃত্য-পাগল ছন্দ, আমি আপনার তালে নেচে যাই, আমি মুক্ত জীবনানন্দ। আমি হাম্বার, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল, আমি চল-চঞ্চল, ঠমকি’ ছমকি’ পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি’ ফিং দিয়া দিই তিন দোল; আমি চপলা-চপল হিন্দোল। আমি তাই করি ভাই যখন চাহে এ মন যা, করি শত্রুর সাথে গলাগলি, ধরি মৃত্যুর সাথে পান্জা, আমি উন্মাদ, আমি ঝন্ঝা! আমি মহামারী আমি ভীতি এ ধরিত্রীর; আমি শাসন-ত্রাসন, সংহার আমি উষ্ন চির-অধীর! বল বীর – আমি চির উন্নত শির!

আমি চির-দুরন্ত দুর্মদ, আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা হর্দম হ্যায় হর্দম ভরপুর মদ।

আমি হোম-শিখা, আমি সাগ্নিক জমদগ্নি, আমি যজ্ঞ, আমি পুরোহিত, আমি অগ্নি। আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি লোকালয়, আমি শ্মশান, আমি অবসান, নিশাবসান। আমি ইন্দ্রাণী-সুত হাতে চাঁদ ভালে সূর্য মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর রণ-তূর্য; আমি কৃষ্ন-কন্ঠ, মন্থন-বিষ পিয়া ব্যথা-বারিধীর। আমি ব্যোমকেশ, ধরি বন্ধন-হারা ধারা গঙ্গোত্রীর। বল বীর – চির – উন্নত মম শির!

আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক, আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক। আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস, আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ! আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার, আমি পিণাক-পাণির ডমরু ত্রিশূল, ধর্মরাজের দন্ড, আমি চক্র ও মহা শঙ্খ, আমি প্রণব-নাদ প্রচন্ড! আমি ক্ষ্যাপা দুর্বাসা, বিশ্বামিত্র-শিষ্য, আমি দাবানল-দাহ, দাহন করিব বিশ্ব। আমি প্রাণ খোলা হাসি উল্লাস, – আমি সৃষ্টি-বৈরী মহাত্রাস, আমি মহা প্রলয়ের দ্বাদশ রবির রাহু গ্রাস! আমি কভূ প্রশান্ত কভূ অশান্ত দারুণ স্বেচ্ছাচারী, আমি অরুণ খুনের তরুণ, আমি বিধির দর্পহারী! আমি প্রভোন্জনের উচ্ছ্বাস, আমি বারিধির মহা কল্লোল, আমি উদ্জ্বল, আমি প্রোজ্জ্জ্বল, আমি উচ্ছ্বল জল-ছল-ছল, চল-ঊর্মির হিন্দোল-দোল!

আমি বন্ধন-হারা কুমারীর বেণু, তন্বী-নয়নে বহ্ণি আমি ষোড়শীর হৃদি-সরসিজ প্রেম উদ্দাম, আমি ধন্যি! আমি উন্মন মন উদাসীর, আমি বিধবার বুকে ক্রন্দন-শ্বাস, হা হুতাশ আমি হুতাশীর। আমি বন্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, আমি অবমানিতের মরম বেদনা, বিষ – জ্বালা, প্রিয় লান্চিত বুকে গতি ফের আমি অভিমানী চির ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড় চিত চুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর! আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল-ক’রে দেখা অনুখন, আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তা’র কাঁকন-চুড়ির কন-কন! আমি চির-শিশু, চির-কিশোর, আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচড় কাঁচলি নিচোর! আমি উত্তর-বায়ু মলয়-অনিল উদাস পূরবী হাওয়া, আমি পথিক-কবির গভীর রাগিণী, বেণু-বীণে গান গাওয়া। আমি আকুল নিদাঘ-তিয়াসা, আমি রৌদ্র-রুদ্র রবি আমি মরু-নির্ঝর ঝর ঝর, আমি শ্যামলিমা ছায়া-ছবি! আমি তুরীয়ানন্দে ছুটে চলি, এ কি উন্মাদ আমি উন্মাদ! আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!

আমি উথ্থান, আমি পতন, আমি অচেতন-চিতে চেতন, আমি বিশ্ব-তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব-বিজয়-কেতন। ছুটি ঝড়ের মতন করতালি দিয়া স্বর্গ মর্ত্য-করতলে, তাজী বোররাক আর উচ্চৈঃশ্রবা বাহন আমার হিম্মত-হ্রেষা হেঁকে চলে!

আমি বসুধা-বক্ষে আগ্নিয়াদ্রি, বাড়ব-বহ্ণি, কালানল, আমি পাতালে মাতাল অগ্নি-পাথার-কলরোল-কল-কোলাহল! আমি তড়িতে চড়িয়া উড়ে চলি জোর তুড়ি দিয়া দিয়া লম্ফ, আমি ত্রাস সন্চারি ভুবনে সহসা সন্চারি’ ভূমিকম্প।

ধরি বাসুকির ফণা জাপটি’ – ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি’। আমি দেব শিশু, আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্ব মায়ের অন্চল! আমি অর্ফিয়াসের বাঁশরী, মহা- সিন্ধু উতলা ঘুমঘুম ঘুম চুমু দিয়ে করি নিখিল বিশ্বে নিঝঝুম মম বাঁশরীর তানে পাশরি’ আমি শ্যামের হাতের বাঁশরী। আমি রুষে উঠি’ যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া, ভয়ে সপ্ত নরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া! আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া!

আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা, কভু ধরনীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা- আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা! আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি, আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণী! আমি ছিন্নমস্তা চন্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী, আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

আমি মৃন্ময়, আমি চিন্ময়, আমি অজর অমর অক্ষয়, আমি অব্যয়। আমি মানব দানব দেবতার ভয়, বিশ্বের আমি চির-দুর্জয়, জগদীশ্বর-ঈশ্বর আমি পুরুষোত্তম সত্য, আমি তাথিয়া তাথিয়া মাথিয়া ফিরি স্বর্গ-পাতাল মর্ত্য! আমি উন্মাদ, আমি উন্মাদ!! আমি চিনেছি আমারে, আজিকে আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ!!

আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার! আমি হল বলরাম-স্কন্ধে আমি উপাড়ি’ ফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব সৃষ্টির মহানন্দে। মহা-বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত, যবে উত্‍পীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না – অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না – বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত আমি সেই দিন হব শান্ত।

আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন, আমি স্রষ্টা-সূদন, শোক-তাপ হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন! আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দেবো পদ-চিহ্ন! আমি খেয়ালী-বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!

আমি চির-বিদ্রোহী বীর – বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির-উন্নত শির!

মানুষ

গাহি সাম্যের গান- মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান্‌ । নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্মজাতি, সব দেশে সব কালে ঘরে-ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।- ‘পূজারী দুয়ার খোলো, ক্ষুধার ঠাকুর দাঁড়ায়ে দুয়ারে পূজার সময় হ’ল!’ স্বপন দেখিয়া আকুল পূজারী খুলিল ভজনালয়, দেবতার বরে আজ রাজা-টাজা হ’য়ে যাবে নিশ্চয়! জীর্ণ-বস্ত্র শীর্ণ-গাত্র, ক্ষুধায় কন্ঠ ক্ষীণ ডাকিল পান’, ‘দ্বার খোল বাবা, খাইনি ক’ সাত দিন!’ সহসা বন্ধ হ’ল মন্দির, ভুখারী ফিরিয়া চলে, তিমির রাত্রি, পথ জুড়ে তার ক্ষুধার মানিক জ্বলে! ভুখারী ফুকারি’ কয়, ‘ঐ মন্দির পূজারীর, হায় দেবতা, তোমার নয়!’ মসজিদে কাল শির্‌নী আছিল,-অঢেল গোস–র”টি বাঁচিয়া গিয়াছে, মোল্লা সাহেব হেসে তাই কুটি কুটি, এমন সময় এলো মুসাফির গায়ে আজারির চিন্‌ বলে, ‘ বাবা, আমি ভূখা-ফাকা আমি আজ নিয়ে সাত দিন!’ তেরিয়া হইয়া হাঁকিল মোল্লা-‘ভ্যালা হ’ল দেখি লেঠা, ভূখা আছ মর গো-ভাগাড়ে গিয়ে! নামাজ পড়িস বেটা?’ ভূখারী কহিল, ‘না বাবা!’ মোল্লা হাঁকিল-‘তা হলে শালা সোজা পথ দেখ!’ গোস–র”টি নিয়া মসজিদে দিল তালা! ভুখারী ফিরিয়া চলে, চলিতে চলিতে বলে- ‘আশিটা বছর কেটে গেল, আমি ডাকিনি তোমায় কভু, আমার ক্ষুধার অন্ন তা ব’লে বন্ধ করনি প্রভু। তব মস্‌জিদ মন্দিরে প্রভু নাই মানুষের দাবী। মোল্লা-পুর”ত লাগায়েছে তার সকল দুয়ারে চাবী!’ কোথা চেঙ্গিস্‌, গজনী-মামুদ, কোথায় কালাপাহাড়? ভেঙে ফেল ঐ ভজনালয়ের যত তালা-দেওয়া-দ্বার! খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়ি শাবল চালা! হায় রে ভজনালয়, তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়! মানুষেরে ঘৃণা করি’ ও’ কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি’ মরি’ ও’ মুখ হইতে কেতাব গ্রন’ নাও জোর ক’রে কেড়ে, যাহারা আনিল গ্রন’-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে, পূজিছে গ্রন’ ভন্ডের দল! মূর্খরা সব শোনো, মানুষ এনেছে গ্রন’;-গ্রন’ আনেনি মানুষ কোনো। আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মাদ কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ, আমাদেরি এঁরা পিতা-পিতামহ, এই আমাদের মাঝে তাঁদেরি রক্ত কম-বেশী ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে! আমরা তাঁদেরি সন্তান, জ্ঞাতি, তাঁদেরি মতন দেহ, কে জানে কখন মোরাও অমনি হয়ে যেতে পারি কেহ। হেসো না বন্ধু! আমার আমি সে কত অতল অসীম, আমিই কি জানি-কে জানে কে আছে আমাতে মহামহিম।

হয়ত আমাতে আসিছে কল্কি, তোমাতে মেহেদী ঈসা, কে জানে কাহার অন- ও আদি, কে পায় কাহার দিশা? কাহারে করিছ ঘৃণা তুমি ভাই, কাহারে মারিছ লাথি? হয়ত উহারই বুকে ভগবান্‌ জাগিছেন দিবা-রাতি! অথবা হয়ত কিছুই নহে সে, মহান্‌ উ”চ নহে, আছে ক্লেদাক্ত ক্ষত-বিক্ষত পড়িয়া দুঃখ-দহে, তবু জগতের যত পবিত্র গ্রন’ ভজনালয় ঐ একখানি ক্ষুদ্র দেহের সম পবিত্র নয়! হয়ত ইহারি ঔরসে ভাই ইহারই কুটীর-বাসে জন্মিছে কেহ- জোড়া নাই যার জগতের ইতিহাসে! যে বাণী আজিও শোনেনি জগৎ, যে মহাশক্তিধরে আজিও বিশ্ব দেখনি,-হয়ত আসিছে সে এরই ঘরে! ও কে? চন্ডাল? চম্‌কাও কেন? নহে ও ঘৃণ্য জীব! ওই হ’তে পারে হরিশচন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব। আজ চন্ডাল, কাল হ’তে পারে মহাযোগী-সম্রাট, তুমি কাল তারে অর্ঘ্য দানিবে, করিবে নান্দী-পাঠ। রাখাল বলিয়া কারে করো হেলা, ও-হেলা কাহারে বাজে! হয়ত গোপনে ব্রজের গোপাল এসেছে রাখাল সাজে! চাষা ব’লে কর ঘৃণা! দে’খো চাষা-রূপে লুকায়ে জনক বলরাম এলো কি না! যত নবী ছিল মেষের রাখাল, তারাও ধরিল হাল, তারাই আনিল অমর বাণী-যা আছে র’বে চিরকাল। দ্বারে গালি খেয়ে ফিরে যায় নিতি ভিখারী ও ভিখারিনী, তারি মাঝে কবে এলো ভোলা-নাথ গিরিজায়া, তা কি চিনি! তোমার ভোগের হ্রাস হয় পাছে ভিক্ষা-মুষ্টি দিলে, দ্বারী দিয়ে তাই মার দিয়ে তুমি দেবতারে খেদাইলে। সে মার রহিল জমা- কে জানে তোমায় লাঞ্ছিতা দেবী করিয়াছে কিনা ক্ষমা!

বন্ধু, তোমার বুক-ভরা লোভ, দু’চোখে স্বার্থ-ঠুলি, নতুবা দেখিতে, তোমারে সেবিতে দেবতা হ’য়েছে কুলি। মানুষের বুকে যেটুকু দেবতা, বেদনা-মথিত সুধা, তাই লুটে তুমি খাবে পশু? তুমি তা দিয়ে মিটাবে ক্ষুধা? তোমার ক্ষুধার আহার তোমার মন্দোদরীই জানে তোমার মৃত্যু-বাণ আছে তব প্রাসাদের কোন্‌খানে! তোমারি কামনা-রাণী যুগে যুগে পশু, ফেলেছে তোমায় মৃত্যু-বিবরে টানি’।

ঈশ্বর

কে তুমি খুঁজিছ জগদীশ ভাই আকাশ পাতাল জুড়ে’ কে তুমি ফিরিছ বনে-জঙ্গলে, কে তুমি পাহাড়-চূড়ে? হায় ঋষি দরবেশ, বুকের মানিকে বুকে ধ’রে তুমি খোঁজ তারে দেশ-দেশ। সৃষ্টি রয়েছে তোমা পানে চেয়ে তুমি আছ চোখ বুঁজে, স্রষ্টারে খোঁজো-আপনারে তুমি আপনি ফিরিছ খুঁজে! ইচ্ছা-অন্ধ! আঁখি খোলো, দেশ দর্পণে নিজ-কায়া, দেখিবে, তোমারি সব অবয়বে প’ড়েছে তাঁহার ছায়া। শিহরি’ উঠো না, শাস্ত্রবিদের ক’রো না ক’ বীর, ভয়- তাহারা খোদার খোদ্‌ ‘ প্রাইভেট সেক্রেটারী’ ত নয়! সকলের মাঝে প্রকাশ তাঁহার, সকলের মাঝে তিনি! আমারে দেখিয়া আমার অদেখা জন্মদাতারে চিনি! রত্ন লইয়া বেচা-কেনা করে বণিক সিন্ধু-কুলে- রত্নাকরের খবর তা ব’লে পুছো না ওদের ভুলে’। উহারা রত্ন-বেনে, রত্ন চিনিয়া মনে করে ওরা রত্নাকরেও চেনে! ডুবে নাই তা’রা অতল গভীর রত্ন-সিন্ধুতলে, শাস্ত্র না ঘেঁটে ডুব দাও, সখা, সত্য-সিন্ধু-জলে।

সন্ধ্যাতারা

ঘোমটা-পরা কাদের ঘরের বৌ তুমি ভাই সন্ধ্যাতারা? তোমার চোখে দৃষ্টি জাগে হারানো কোন্‌ মুখের পারা।

সাঁঝের প্রদীপ আঁচল ঝেঁপে বঁধুর পথে চাইতে বেঁকে চাউনিটি কার উঠছে কেঁপে রোজ সাঁঝে ভাই এমনি ধারা।

কারা হারানো বধূ তুমি অস-পথে মৌন মুখে ঘনাও সাঁঝে ঘরের মায়া গৃহহীনের শূন্য বুকে।

এই যে নিতুই আসা-যাওয়া, এমন করাণ মলিন চাওয়া, কার তরে হায় আকাশ-বধু তুমিও কি আজ প্রিয়-হারা।

চাঁদনী-রাতে

কোদালে মেঘের মউজ উঠেছে গগনের নীল গাঙে, হাবুডুবু খায় তারা-বুদবুদ, জোছনা সোনায় রাঙে! তৃতীয়া চাঁদের “সাম্পানে” চড়ি চলিছে আকাশ প্রিয়া, আকাশ-দরিয়া উতলা হ’ল গো পুতলায় বুকে নিয়া। তৃতীয়া চাঁদের বাকি “তের কলা” আবছা কালোতে আঁকা নীলিম-প্রিয়ার নীলা “গুল রুখ” অব-গুণ্ঠনে ঢাকা। সপ্তর্ষির তারা-পালঙ্কে ঘুমায় আকাশ-রাণী, সেহেলি “লায়লী” দিয়ে গেছে চুপে কূহেলী-মশারী টানি! দিক-চক্রের ছায়া-ঘন ঐ সবুজ তরুর সারি, নীহার-নেটের কুয়াশা মশারি –ওকি বর্ডার তারি? সাতাশ তারার ফুল-তোড়া হাতে আকাশ নিশুতি রাতে গোপনে আসিয়া তারা-পালঙ্কে শুইল প্রিয়ার সাথে! উহু উহু করি কাঁচা ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে নীলা হুরী, লুকিয়ে দেখে তা ‘চোখ গেল’ বলে চেঁচায় পাপিয়া ছুঁড়ি! ‘মঙ্গল’ তারা মঙ্গল-দীপ জ্বালিয়া প্রহর জাগে, ঝিকিমিকি করে মাঝে মাঝে- বুঝি বধূর নিশাস লাগে! উল্কা-জ্বালার সন্ধানী-আলো লইয়া আকাশ-দ্বারী ‘কাল-পুরুষ’ সে জাগি বিনিদ্র করিতেছে পায়চারি!

সেহেলিরা রাতে পালায়ে এসেছে উপবনে কোন আশে, হেথা হোথা ছোটে-পিকের কণ্ঠে ফিক ফিক ক’রে হাসে! আবেগে সোহাগে আকাশ-প্রিয়ার চিবুক বাহিয়া ও কি শিশিরের রূপে ঘর্ম-বিন্দু ঝ’রে ঝরে পড়ে সখি, নবমী চাঁদের ‘সসারে’ ও কে গো চাঁদিনী-শিরাজি ঢালি’ বধূর অধর ধরিয়া কহিছে- ‘তহুরা পিও লো আলি’! কার কথা ভেবে তারা-মজলিসে দূরে একাকিনী সাকী চাঁদের ‘সসারে’ কলঙ্ক-ফুল আনমনে যায় আঁকি। ফরহাদ-শিরী-লায়লী-মজনু মগজে ক’রেছে চিড়, মস্তানা শ্যামা দধিয়াল টানে বায়ু-বেয়ালার মীড়! আনমনা সাকী! অমনি আমারো হৃদয় পেয়ালা-কোণে কলঙ্ক-ফুল আনমনে সখি লিখো মুছো ক্ষণে ক্ষণে।

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ধরনের আরো সংবাদ