1. kabir28journal@yahoo.com : Abubakar Siddik : Abubakar Siddik
  2. kabir.news@gmail.com : Kabir :
মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৯ পূর্বাহ্ন

বই বনাম খবরের কাগজ 

সাংবাদিকের নাম:
  • আপডেট টাইম: শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪
  • ৩৫ ০০০ জন পড়েছে।
জনজীবন ডেস্ক—–
 
কোকিলকে বলা হয় বসন্ত -সখা। তাহলে পাঠককে কী বই -সখা বলা যেতে পারে? পারে না। পাঠকের বৈচিত্র্য আছে, কোকিলের কুহুতে ভেদ নেই। ফলে পাঠক বই -সখা বই -সই হয়েও উঠেনি। আবার বই বৈষয়িক সম্পদও নয়। ফলে পাঠকের খাসতালুকে বই হয় অতিযত্নের সংরক্ষণে অকেজো হয়ে রয়েছে, নয় অবহেলার শিকার হয়ে ধূলায় মলিন হয়ে উঠেছে। তাই বিশ্ব বই দিবসের আলোয় বই পাঠকের হরগৌরীসুলভ মিলনদৃশ্যটি আর উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না। 
লেখক পাঠক চায়, তার মানে এই নয় যে পাঠকের মনের মতো করে লেখককে লিখতে হবে। লেখক তাঁর মনের তাগিদে লিখবেন এবং পাঠকের মনে সেই তাগিদের উপযোগিতা লেখার মাধ্যমে তুলে ধরবেন। আর তা থেকে বিচ্যুত হয়ে পাঠকের মনের খোরাকের চাহিদা মাফিক লিখতে গেলেই বইয়ের পসার হয়তো বাড়বে কিন্তু বইয়ের চিরন্তন সমাদর হারিয়ে যাবে। 
একসময় নাট্যকার -অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ দর্শকের দিকে লক্ষ্য রেখে প্রচুর নাটক লিখে মঞ্চসফল হয়েছিলেন। সেই নাটকগুলি তাঁর মৃত্যুর পরেই বিস্মৃত হয়ে যায়। তাই অসুস্থ খবরখাদকের জীবনে বিশ্ব বই দিবসের কোনও প্রভাব পড়ে না। ভোগবাদী জীবনে খবরের কাগজ বা রঙিন পত্র -পত্রিকা ভোগের সহায়ক, সেক্ষেত্রে বই তো ভোগের অন্তরায়। তার উপর ছাত্রজীবনে দায়ে পড়ে দারপরিগ্রহের মতো বছর বছর গাদাগাদা নোট -বই পড়ার হ্যাপা পোয়ানো থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বই পড়ার স্বাদটাই হারিয়ে যায়। তাই এখন কেউ বই পড়ছে শুনলেই অনেকের মনে ছাত্রছাত্র ভাবের উদয় হয়। 
বর্তমানে একটি আশ্চর্য বিষয় লক্ষ্য করা যায়, বইপড়া কমলেও এখন আগের থেকে পত্রপত্রিকা বিশেষকরে খবরের কাগজ পড়ার বহর বেড়েই চলেছে। একেকজন খবরখাদকের এতই নেশা যে, একই দিনে একাধিক খবরের কাগজ পড়ে থাকেন। ফলে তাঁদের বইয়ের পাতা উল্টালেই ঘুম এসে যায়। পত্রপত্রিকার কর্মকর্তারাও এই খবরখাদকের রসদের ভাঁড়ারটি বেশ উপাদেয় করে সাজিয়ে তোলেন। সেজন্য অধিকাংশ পত্রপত্রিকারই লক্ষ্যে থাকে পাঠক কোন খবরটা খাবে বেশি সেই ধরনের খবরই ছাপা হয় সেই পত্রপত্রিকায়। অর্থাৎ অধিকাংশ খবরের কাগজের খবরে সামাজিক দায়ের চেয়ে বিক্রি ও বিজ্ঞাপনের দায়টাই বড় হয়ে উঠেছে। ফলে  এখনকার খবরের চমকে চুমুক দিয়ে খবরখাদকের তৃষ্ণা যেমন বেড়ে চলে, তেমনই রসনা পরিতৃপ্তি করতে গিয়ে হজমের যন্ত্রটি বিকল হয়ে পড়ে। তার ফলে মননের ক্ষুধা হয় মরে যায়, নয়তো গলাধঃকরণের পর হজম হয় না। এ জন্য খবর -খাদকদের বইপড়া আর হয়ে ওঠে না। একসময় হয়তো এমন হয়ে যাবে যখন বইও সেই খবরের  চমকের বিষয় ও ভাষায় লেখা হবে। 
হাতে হাতে ছিল উপন্যাস –
আর আসে না কিশোরবেলা  – আগে আমরা ছোটবেলায় ভাইবোনেরা কাড়াকাড়ি করে, হুমড়ি খেয়ে পড়তাম রূপকথার বই। আরও ছিল বাটুল দি গ্রেট, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা ভোঁদা। জনপ্রিয় কমিকসের জনপ্রিয়তার কথা স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে আজও। 
একটু বড় হয়ে পড়েছি ঠাকুরমার ঝুলি, পাগলা দাশু, আবোল -তাবোল। 
সপ্তম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময়ে চিত্রালী আর চিত্রাকাশ -এর হয়েছিলাম প্রেমিক। 
ছোটবেলায় ছিল পাড়ায় পাড়ায় লাইব্রেরি – সেখান থেকে বা অন্য বন্ধু’কে ধরে গ্রন্থাগারে গিয়ে কিংবা ধার করে বই পড়ার অভ্যাস। অভ্যাস বলবো না, সে যেন এক নেশা। দেবদাস, মেজদিদি, কপালকুণ্ডলা নিয়েছিল মন কেড়ে। হাতে হাতে ঘুরতে ঘুরতে জীর্ণ হয়ে যেত বই। এই ধারা অব্যাহত কলেজ – বিশ্ববিদ্যালয় হষ্টেলেও। এখন এই রেওয়াজ কমে গেছে। 
আজকের বাচ্চারা পাঠ্যবইয়ের চাপেই বোধহয় হিমশিম। 
বই পড়া একটি সংস্কৃতি – ছোটদের ভেতর তা চারিয়ে দেওয়া উচিত। বইমেলায় বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া উচিত অভিভাবকদের। আর দরকার বই কিনে উপহার দেওয়ার রেওয়াজটা বাঁচিয়ে রাখা। 
কেন জানি মনে হয়, দৈনিক কাগজগুলোতে সপ্তাহে অন্তত একদিন ছোটদের পাতা থাকা উচিত। 
একবার সৈয়দ মুজতবা আলী কৌতুকের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন , আমরা বই পড়াটাকে কীভাবে নেহ্যত সময় ও অর্থের অপচয় হিসেবে দেখি। 
বিমল মিত্রের একটি গল্পে পড়েছিলাম, ভাইঝির বিয়ে ঠিক করতে এক পণ্ডিতমশাই গিয়েছিলেন জমিদার বাড়িতে। তাঁর সব পছন্দ, তবু বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। কারণ, একটাই, এত বড় ঘর, এত বৈভব, কিন্তু কোথাও বইয়ের চিহ্ন নেই। 
বসন্তকালে বইমেলাকে ঘিরেই চারিদিকে বসন্তোৎসবে মেতে রয়েছে। তাই বইমেলার কথা মনে এলেই কেমন চোখে ভেসে ওঠে, রঙিন ফুলের মাঝে হাজারটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। মনের কোণে উঁকি দেয় শরৎ, বঙ্কিম, রবীন্দ্র নামগুলি। 
বইমেলা হচ্ছে লেখক, পাঠক, প্রকাশক ও সংস্কৃতিমনা মানুষের মিলনক্ষেত্র। 
ব্যক্তি, সমাজ, জাতি, রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে শিক্ষালাভ ও জ্ঞান অর্জনের উৎস হল বই। স্বাধীন চিন্তা, কল্পনাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই। 
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ” বই হচ্ছে অতীত আর বর্তমানের মধ্যে বেঁধে দেওয়া সাঁকো। বই অতীত থেকে ভবিষ্যৎ, নিকট থেকে দূরে, প্রান্ত থেকে অন্তে, যুগ থেকে যুগান্তরে আলো ছড়ায়। “
কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন,” বই পড়াকে যথার্থ হিসেবে যে সঙ্গী করে নিতে পারে, তাঁর জীবনের দুঃখকষ্টের বোঝা অনেক কমে যায়।” কিন্তু ঘটনা হলো, বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস দিন দিন কমে যাচ্ছে। 
অ্যাকাডেমিক লেখাপড়া শেষ হলে অনেকের জীবন থেকে বই চিরতরে হারিয়ে যায়। বর্তমানে ডিজিটাল যুগে সারাক্ষণ হাতে মোবাইল ভুলিয়ে দিয়েছে বইয়ের টান। কিন্তু পুরনো বই আলমারি থেকে নামিয়ে তার তার পাতাগুলো স্পর্শ করা সুখ, আঘ্রাণ নেওয়ার তৃপ্তি সত্যিই কি ভোলা যায়? ডিজিটাল ডিভাইসে বই পড়ার বিকল্প হতে পারে না। 
বইয়ের পাশাপাশি ছোট কাগজ বড় আশা – অন্যতম প্রধান লিটল ম্যাগাজিন মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয় একাধিক পত্রপত্রিকা ও বই। বইমেলায় দেখতে পাওয়া যায় নামী -অনামী পত্রপত্রিকার বিপুল সমাবেশ। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত খ্যাতনামা সাহিত্যিকদের সঙ্গে একগুচ্ছ নতুনদেরও কখনও কখনও স্থান পাওয়ার সৌভাগ্য ঘটে। 
বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি – এই কথা হজম করেই বলা যায় – বাংলা ভাষায় চার ও পাঁচের দশকে ছোট ছোট বই প্রকাশিত হত। জ্ঞান -বিজ্ঞান চেতনা ও জীবনী গ্রন্থমালা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতো একজন প্রখ্যাত দার্শনিক ছিলেন তার সম্পাদক। সেখানে ‘ সে -যুগে মায়েরা বড়ো ‘, ‘ ক্ষুদে শয়তানের রাজত্ব ‘, ‘ শোনো বলি মনের কথা ‘, ‘ পৃথিবীর ইতিহাস ‘ এমন সব বই বেরিয়েছিল। কিন্তু তা আজ কোথায়? বাঙালি বেমালুম ভুলে গেছে, বাংলা সাহিত্যে সাময়িক পত্রের ভূমিকার সূচনা যে হয়েছিল ১৯১৮ সাল থেকে। তারপর বঙ্গদর্শন হয়ে আজ পর্যন্ত অসংখ্য সাময়িক পত্র, প্রবন্ধ, সাহিত্য ও বাংলা উপন্যাস, গল্প, কবিতার এক বিশাল ক্ষেত্র নির্মাণ হয়েছিল। আর লিটল ম্যাগাজিনকে তো বলা হয় বাংলা সাহিত্যের বীজতলা। 
আবার এ-ও দেখা গেছে, একসময়ের জনপ্রিয় লেখক -লেখিকারা মাত্র ৫০ বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান। কিন্তু কেন? যেমন ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় প্রায় ২ দশক ধরে জনপ্রিয়তার চূড়ায় ছিলেন। আসল নাম তারাদাস মুখোপাধ্যায়। এই ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের লেখা – বহ্নিমান, হে মোর দুর্ভাগা দেশ, আকাশ বনানী জাগে, পথের ধুলো, আশার ছলনে ভুলি ইত্যাদি বই বেষ্ট সেলার হয়েছিল একসময়ে। ‘গুণধর ছেলে’ ও তাঁর লেখা বিখ্যাত কিশোর উপন্যাস। কিন্তু আজ সেসব বইয়ের নাম জানা তো দূরের কথা, লেখকের নামই কেউ জানেন না। 
ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখে একসময় বিখ্যাত হয়েছিলেন শ্রীপারাবত। ‘ আমি সিরাজের বেগম ‘থেকে শুরু করে ‘মেবার পত্নী পদ্মিনী ‘, ‘মমতাজ দুহিতা জাহানারা’, ‘সিংহদ্বার’, ‘মিশর সম্রাজ্ঞী হতশেপসুত’, ‘আকাশের নীচে মানুষ’, ‘রাজমহিষী’, ‘চন্দ্রকেতুগড়’, ‘বাহাদুরশাহ’, ‘বেগমের নাম দেবলরাণী’র মতো অজস্র উপন্যাস লিখেছেন। 
সাধারণের বিশ্বাস, ঐতিহাসিক উপন্যাস যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকে। কিন্তু অবধূত বিস্মৃত না হলেও একালের কেউ শ্রীপারাবতের নামও উচ্চারণ করেন না। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক প্রমথনাথ বিশীর কথাও লোকে ভুলে গেছেন। অথচ তাঁর লেখা কেরী সাহেবের মুন্সী ১৯৬০ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পায়। 
হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস পড়ার টানে একসময় বিভিন্ন মাসিক পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা হই হই করে বিক্রি হতো। প্রতিটি উপন্যাসই জনপ্রিয় ছিল। ‘ইরাবতী’, ‘আরাকান’, ‘চন্দনাবাঈ’, ‘মৃত্তিকার রঙ’ ইত্যাদি বইয়ের কথা হয়তো আজও অনেক প্রবীণের মনে পড়বে। 
একসময় শচীন দাশ, দেবল দেববর্মাও খুব নাম কিনেছিলেন। কিন্তু শৈলজারঞ্জন মজুমদার, দীপক চৌধুরী, তুলসী মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, 
গৌতম রায়, গিরিধারী কুন্ডু, সুব্রত সেনগুপ্ত, দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যিকরা কবেই হারিয়ে গেছেন। অথচ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, রাজশেখর বসু, শিবরাম চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলী, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নন্দী, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুবোধ ঘোষ প্রমুখ সেকালে প্রচারের ঠেলায় জনপ্রিয়তম লেখক না হলেও আজও ওই পুরোনো গদ্যরীতি পড়ে পাঠক পাঠিকা আনন্দ পান। 
লেখকের দীর্ঘকাল টিকে থাকার মানদণ্ড যে জনপ্রিয় হওয়া নয়, তা আজ স্পষ্ট। 
নদীর প্রবল স্রোতেও কে যে থেকে যাবেন, তা কেউ জানেন না। তবে বছর ঘুরে ঘুরে একুশে ফেব্রুয়ারি আসবে – বইমেলা হবে। অনেকে বলেন,  সবাই একটি করে বই কিনুন। 
কিন্তু একটি কেন? 
যা যা ভালো লাগবে, যে যে বই ভালো লাগবে তাই কিনুন। বইয়ের বিকল্প কিছুই হতে পারে না। 
 
লিয়াকত হোসেন খোকন, 
রূপনগর, ঢাকা, বাংলাদেশ।
 
 
 
 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ ধরনের আরো সংবাদ