মোগল নারীদের মধ্যে অনেকেই কেবল আক্ষরিক ক্ষেত্রে নয়, বাস্তবিক ক্ষেত্রেও ছিলেন সম্রাটের প্রকৃত ‘অর্ধাঙ্গিনী। মোগল হেরেমের রমণীগণ তাদের মধ্য এশীয় ঐতিহ্যানুযায়ী প্রায় সকলেই অশ্বারোহণ করতেন, যাকে বেখাপ্পা বা পুরুষালী আচরণ বলে মনে করা হত না।
প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরের কন্যা, আকবরের ফুফু গুলবদন বেগমের হুমায়ূননামা কেবল প্রামাণ্যিক ঐতিহাসিক দলিলই নয়, প্রকৃষ্ট সাহিত্য-কর্মও বটে। আকবরের মাতা হামিদা বানু ছিলেন বিদুষী ও তেজস্বিনী নারী। আকবরের অন্যতম মহিষী সেলিমা বেগম ছিলেন গুণবতী রমণী। পুত্র জাহাঙ্গীর যখন পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন, তখন বিমাতা সেলিমা বেগমই মধ্যস্থতা করে শান্তি স্থাপন করেছিলেন। দারাশিকোর কন্যা শাহজাদা আযমের স্ত্রী এবং সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্রবধূ দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন।
মোগল হেরেমের রমণীকুলের মধ্যে নানা কারণে বিখ্যাত হয়ে আছেন বাবর-কন্যা গুলবদন বেগম, সম্রাজ্ঞী নূরজাহান, শাহজাহান মহিষী মমতাজ মহল, দারাশিকোর স্ত্রী নাদিরা বেগম, আওরঙ্গজেব-কন্যা কবি জেবুন্নিসা, শাজাহান-কন্যা রওশন আরা, শাজাহান-দুহিতা জাহানারা এবং বাহাদুর শাহ জাফরের স্ত্রী জিনাত মহল। তবে প্রায় সকলেই নানা কারণে ও যোগ্যতায় আলোচিত-বিখ্যাত হলেও নূরজাহান আর জাহানারার এবং জেবুন্নেসা ইতিহাস অন্য সকলের চেয়ে আলাদা এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।
নূরজাহান বা জগতের আলো নামে খ্যাত এই মোগল রমণী কেবল ভারতবর্ষ বা মোগল ইতিহাসেই নন, বিশ্বইতিহাসেরও এক বিস্ময়কর নারী-ব্যক্তিত্ব। তাবৎ পুথিবীর ইতিহাসে তাঁর সমকক্ষ খুব কম নারীরই দেখা পাওয়া যায়। মোগল প্রশাসন ও কীর্তিতে নূরজাহানের পারিবারিক অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী মমতাজ মহল বিশ্ববিস্ময় তাজমহলে চিরশায়িতা। দৌহিত্রী বাদশাবেগম জাহানারা মোগল ইতিহাসে কল্যাণময়ীর উজ্জ্বল-প্রতীক। তাঁর অধস্থন বংশধর আওরঙ্গজেব-কন্যা জেবুন্নিসা ললিতকলায় অবদানের জন্য চিরনন্দিতা।
নূরজাহানের কাব্য-প্রতিভা স্বরচিত ফারসি কবিতার বই দিওয়ানে মাকফি তে লিপিবদ্ধ, যা তার উচ্চতর কবি পরিচয়কেও অন্যবিধ দক্ষতার পাশাপাশি তুলে ধরে। স্বামী জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাঝে মাঝে স্বরচিত কবিতায় বাক্যালাপ করতেন, যাকে বলা হয় ‘নাজ’ ও ‘নাখরা’। আবার এককভাবে স্বরচিত কাব্যপাঠ বা ‘মুশায়েরা’ তাঁর সময় থেকেই উপমহাদেশের সাহিতাঙ্গনে বৃদ্ধি পেতে থাকে। পরবর্তীকালে এই মুশায়েরা উত্তর ভারতের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব-অনুষ্ঠানে পরিণত হয়, যা এখন পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে। নূরজাহানের নিজস্ব-ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল। সম্রাজ্ঞী হওয়ার পূর্বে তাঁর আপন হস্তাক্ষর মির্জা কামরানের দিওয়ান-এর প্রথম পাতায় পাওয়া যায়।
নূরজাহান আসলেই কত ক্ষমতাবান এবং মর্যাদাসম্পন্ন ছিলেন, তার প্রমাণ তিনি জীবনকালে এবং মৃত্যুর পরেও রেখে গেছেন। আওরঙ্গজেব তাঁর ক্ষমতাকে প্রাসাদভিত্তিক প্রতিরোধ ও আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য নূরজাহানকে নজর বন্দি করে রাখেন। মৃত্যুর পর দিল্লিতে অবস্থিত তাঁর মাযার পূত-পবিত্র স্থান হিসাবে আপামর জনসাধারণের সমাবেশের স্থানে পরিণত হলে সিপাহি বিদ্রোহের পর পরই ভীত ইংরেজ প্রশাসন মাযারকে দিল্লি থেকে সরিয়ে লাহোরে স্থানান্তরিত করে, যা এখনও সেখানে তাঁর নিজেরই প্রতিষ্ঠিত শালিমার বাগে অবস্থিত রয়েছে।
——————————————
বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর ভাগ্যের উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে নূরজাহানের ঐশ্বর্যময় জীবন। প্রথম যৌবনে বধূবেশে নূরজাহানের বাঙলায় আগমন ও অবস্থান। সতের বছরকাল তিনি এই বাঙলাতেই বিবাহিত জীবন-যাপন করেন। বাঙলাপ্রীতির স্বাক্ষরও দেখা যায় নূরজাহানের জীবন-ইতিহাসে। নূরজাহান লাহোরের নলখা বাঙালি মহল ভবন স্থাপন করেন বাংলার কুটির আর মোগল স্থাপত্যের মেলবন্ধনে। নূরজাহানের পৃষ্ঠপোষকতায় পরবর্তীকালে ঢাকার মসলিনের একটি নাম ও ডিজাইন উন্নত করা হয়, যাকে বলা হতো ‘আবে রাওয়াঁ’ বা ‘জলের ইন্দ্রজাল’।
কুশলী নূরজাহান নানা ধরনের পোষাক আর ফ্যাশনেরও উদ্ভাবক। তাঁর সময় ভোজের সময় দস্তরখানের ব্যবহার, চোলি বা আধুনিক ব্লাউজের প্রচলন, পোশাকে বোতাম, বাদলা, কিঙ্গারি, ওড়না, অন্তর্বাস, নৈশবেশ, কুর্তা, শিলওয়ার, কামিজ এবং জরির লেসের উদ্ভব ও প্রচলন করেন তিনি, যা ভারতবর্ষে ছিল অভূতপূর্ব। সৌন্দর্য চর্চায় নূরজাহানের সবচেয়ে খ্যাতিমান আবিষ্কার গোলাপের আতর, যার পোশাকী নাম ‘আতরে জাহাঙ্গীরী’। তাঁর বিশিষ্ট গোসলখানাটিও একটি আগ্রহ আর গবেষণার বিষয়। বিলাসবহুল গোসলখানার টবে গোলাপ মিশ্রিত পানিতে তরলাকার ভাসমান পদার্থের মধ্যে গোলাপের নির্যাস ছড়িয়ে রাখা হতো। নূরজাহানের স্নানের গোলাপ পানিতে আতর, চন্দন, রূপটান ও অন্যান্য প্রসাধনী সামগ্রী মিশ্রিত থাকতো।
সুকন্যা নামের এক গবেষক নূরজাহান শিরোনামের এক জীবনী গ্রন্থে লিখেছেন: “নূরজাহান নিজে সুরভিত হতেন গোলাপ নির্যাসের স্নানে, যার দৈনিক খরচ পড়ত তৎকালীন তিন হাজার টাকা। ”
নূরজাহানের প্রথম স্বামী বাংলার রাঢ়-বর্ধমান অঞ্চলের জায়গিরদার শের আফগান দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিবাদের জেরে নিহত হন। বিধবা নূরজাহান বিজয়ী দিল্লির সৈন্যদল কর্তৃক আটক হয়ে একমাত্র কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে আগ্রার দুর্গে চার বৎসর বন্দিত্ব আর বৈধব্যময় জীবন কাটান। এখানে এসে ভাগ্য আবার তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। আকস্মাৎ সম্রাট জাহাঙ্গীর এক মিনাবাজারে নূরজাহানের রূপ-লাবণ্য দর্শনে মুগ্ধ হয়ে কেবল বিবাহ নয়, তাঁর প্রধান রাজমহিষীর মর্যাদা প্রদান করেন। অবস্থা এতটাই তাঁর অনুকূলে চলে আসে যে, ইন্দ্রানী মুখার্জী মুঘল হারেম: কয়েকটি নিদের্শনামা গ্রন্থে জানাচ্ছেন যে, “জাহাঙ্গীর নাকি বলতেন, আমি মদ ও মাংসের কথা জানি, সাম্রাজ্যের খবর রাখেন নূরজাহান। ”
শুধু প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই নয়, নূরজাহান মোগল হেরেমে এসে পারিবারিক কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠা করেন। নূরজাহানের আগমনের পর জাহাঙ্গীরের বহুনারীবিশিষ্ট হেরেমে একস্বামী-একস্ত্রীর দাম্পত্যের সূচনা ঘটে। তিনিই প্রথম মোগল সম্রাজ্ঞী, ঝরকায় সম্রাট যখন প্রজাদের দর্শন দিতেন, তখন পাশে থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিতেন। তিনি প্রজাদের মনে রাজা-রাণীর যৌথতায় রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক সৃষ্টি করেন। রাজ্যশাসন ছাড়াও যুদ্ধ এবং শিকার যাত্রায় নূরজাহান সম্রাটের সহগামী হতেন। উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য থেকে জানা যায় যে, তিনি নিজে বন্দুক চালিয়ে অনেক বাঘ শিকার করেছেন। তাঁর অভেদ্য নিশানা দেখে মুগ্ধ সম্রাট জাহাঙ্গীর এক লক্ষ মুদ্রার সমমানের হীরার চূড় এবং এক হাজার নগদ আশরাফি উপহার দেন।
সম্রাজ্ঞীর উপযুক্ত শিকারের পোশাক ব্রিচেস ও হান্টিং কোট তৈরির জন্যেও সম্রাট জাহাঙ্গীর ইংরেজ কোম্পানিকে নিদের্শ দেন। স্যার টমাস রোঁ প্রদত্ত ল্যান্ডো গাড়ি জাহাঙ্গীর তাঁর বিবাহ বার্ষিকীতে সর্বপ্রথম নূরজাহানকে সঙ্গে নিয়ে ব্যবহার করেন। সেই বিবেচনায় উপমহাদেশে প্রথম আধুনিক মোটর গাড়ি ব্যবহারের কৃতিত্ব সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাজ্ঞী নূরজাহানের। কাচ্চি বিরিয়ানির প্রবর্তনকারীও নূরজাহান। তিনি তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে অভ্যাগত অতিথিদের আপ্যায়নের জন্য মৃগনাভি সুরভিত জাফরানি কাচ্চি বিরিয়ানি পরিবেশনের ব্যবস্থা করেন।
প্রতিভাধর নূরজাহানের তত্ত্বাবধানে নির্মিত দু‘টি স্থাপত্যকীর্তিই সমাধিসৌধকেন্দ্রিক। প্রথমটি আগ্রায় পিতা ইতিমুদ্দৌলার সমাধিসৌধ। অপূর্ব মোজাইকের কারুকাজ করা স্থাপত্যশিল্পটি সম্পূর্ণ মর্মর দিয়ে নির্মিত পিটাড়ৌরার চিত্রে শোভিত রত্নালঙ্কারের মতোই মনোমুগ্ধকর। পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু এই সমাধিসৌধকে ‘স্থাপত্যের রত্ন’ বলে প্রশংসা করেছেন। পার্সি ব্রাউন এই সুনির্মাণটির সুখ্যাতি করে বলেছেন ‘নান্দনিক আদর্শের পরাকাষ্ঠা’। নূরজাহান নির্মিত দ্বিতীয় স্থাপত্যকর্মটি হলো লাহোরের শাদারায় অবস্থিত পতি-সম্রাট জাহাঙ্গীরের সমাধিসৌধ।
**************************
সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর কিছুটা ভাগ্যবিড়ম্বিতা নূরজাহান আপন ভাগ্য মেনে নিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এমন কি মোগল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু দিল্লি-আগ্রাও ত্যাগ করেন। শান্তিময় নির্বিরোধী জীবন-যাপনের জন্য তিনি সঙ্গী বেছে নেন আপন বিধাব কন্যাকে আর বসবাসস্থল হিসাবে নির্ধারণ করেন স্বীয় স্বামীর স্মৃতিময় লাহোর শহর। সম্রাট শাজাহান তাঁর অন্যতম সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বী নূরজাহানের নির্বিবাদী জীবন-যাপনে স্বস্তি বোধ করেন এবং তাঁকে বাৎসরিক দুই লক্ষ টাকা ভাতা বরাদ্দ করেন্য। তাঁর সময় অতিবাহিত হতে থাকে স্বামীর সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজে, সাহিত্য-কাব্য চর্চায় এবং দীন-দুখীদের মধ্যে দান-খয়রাত করে।
শেষ বয়েসে সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁকে বিপদজ্জনক মনে করে আগ্রা দুর্গে বন্দি করেন। নিজের ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুর পর স্বামীর সমাধিস্থল লাহোর শহরে শেষ নিদ্রায় সমাহিত করা হয়। ভাগ্যের প্রবল উত্থান আর পতনে টালমাতাল সম্রাজ্ঞী নূরজাহান ক্ষমতা, যোগ্যতা, কুশলতা আর সৌন্দর্যপ্রিয়তায় উজ্জ্বল নিদর্শনের মতোই নিজের অতি সাধারণ সমাধিতে খোদিত করে রেখেছেন স্বরচিত বিখ্যাত কয়েকটি কথা: “বর মাযারে-ই মা গরীবান নই চিরাগি নাই গুলে/ নে পর-ই পরওয়ানা সুজদ নই সদা-ই বুলবুলে। ”
সুদীর্ঘ মোগল ইতিহাসে নূরজাহানের পরেই বহুমাত্রিক যোগ্যতা আর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য জাহানারার নাম চলে আসে। শাজাহান-মমতাজ দুহিতা, জাহাঙ্গীর-নূরজাহান দৌহিত্রী জাহানারা মোগল সংস্কৃতির সুকুমার গুণে উজ্জ্বল ঘটনাবহুল জীবনের অধিকারী। তাঁর অবস্থান প্রথাগত নারীর শেষ প্রান্তে এবং আধুনিক নারীর প্রথম পাদে। ঐতিহাসিক কালিকারঞ্জন কানুনগো শাহজাদা দারাশিকো গ্রন্থে লিখেছেন: “পুণ্যশীলা জাহানারা বেগম মহিমাময়ী নারী, সম্রাট পরিবারের পারিজাত প্রসূন। তাঁকে কখনও কুদসিয়া বেগমও বলা হতো। ”
প্রসঙ্গত, মোগল হেরেমে নারীদের পদ-মর্যাদা ও ক্ষমতাগত অবস্থানের বিষয়টি তুলে ধরা যেতে পারে। মোগল সম্রাটগণ শাহী মহলের কর্তৃত্ব দিয়ে ‘পাদশা বেগম’ (বাদশাহর ফারসি উচ্চারণ পাদশা) পদ-মর্যাদা দান ছাড়া কোন কোন মহিলাকে সীমিতভাবে ‘নির্দেশিকা ক্ষমতা’ দান করতেন। তাঁদের মধ্যে রাজমাতা, রাজমহিষী, রাজকন্যা ইত্যাদি পদবী ছিল। রাজমাতার নিদের্শিকাকে বলা হতো ‘হুকুমনামা’, অনুরূপ অধিকার রাজমহিষীও ভোগ করতেন। রাজকন্যা বা বাদশাজাদীর নির্দেশিকাকে বলা হতো ‘নিশান’। এগুলো প্রশাসনিক নির্দেশিকার সমতুল্য। এই ক্ষমতা বা অধিকার শরিয়ত বিধানে নেই। সম্পূর্ণ মোগল রাজশক্তির সৃষ্ট অধিকার বা ক্ষমতা মোগল নারীর বিশেষ উচ্চ মর্যাদার তথ্য জ্ঞাপন করে। এইভাবে নূরজাহানের কিছু হুকুমনামা এবং জাহানারার দশটি নিশানের সংবাদ পাওয়া যায়।
বিখ্যাত মাতা মমতাজ মহলের মৃত্যুর পর পিতা সম্রাট শাজাহান অন্য পুররমণীগণের বদলে জাহানারাকেই কেবল শ্রেষ্ঠ মর্যাদা ‘পাদশা বেগম’ প্রদান করেন, যা নূরজাহান বা মমতাজের মত সম্রাজ্ঞীর বিশেষণ ছিল এবং জাহানারাই একমাত্র মোগল রমণী যিনি সম্রাজ্ঞী না-হয়েও কেবলমাত্র শাহজাদী থেকেও ‘পাদশা বেগম’ পদ লাভ করেন। সম্রাট শাজাহান কন্যাকে সর্বোচ্চ নারীর পদাধিকারী করার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজ প্রসাদের বাইরে আপন মহল তৈরি করে বসবাস করার অধিকার দিয়েছিলেন এবং ব্যবস্থা করেছিলেন স্বাধীনভাবে পর্যাপ্ত আয়-উপার্জনেরও।
পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বকালীন ধনী সম্রাট সুরুচিশীল শাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা রূপে-গুণে-শিক্ষায় অদ্বিতীয়া এই জাহানারা। তাঁর শিক্ষার জন্য সতিউননিসা নামের উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষয়েত্রী নিয়োগ করেন পিতা। মাতার মৃত্যুর পর রাজমহিষীর প্রাপ্য ‘পাদশা বেগম’ মর্যাদা পেয়ে তিনি হলেন শাহী মহলের সর্বময়ী কর্ত্রী। আওরঙ্গজেব সম্রাট হবার পরও তাঁকে সেই উচ্চ পদ-মর্যাদা থেকে বিচ্যুত করেন নি। ত্রিশ বৎসর ধরে তিনি দিল্লি-আগ্রার শাহী সীল মোহর সংরক্ষণের অধিকারিনী থাকেন, যদিও তিনি ভ্রাতার জিজিয়া কর আরোপের বিরোধী ছিলেন। সুরাটের বাণিজ্য শুল্ককরের জায়গির তাঁকে দেওয়া হয়, যার বার্ষিক আয় ছিল তৎকালীন ছয় লক্ষ টাকা। বিভিন্ন উৎস থেকে এক পর্যায়ে জাহানারার বার্ষিক আয় দাঁড়ায় সে আমলের সতের লক্ষ টাকা। আপন কর্তৃত্বাধীনে শিল্প-কল-কারখানা পরিচালনা করতেন তিনি এবং তাঁর নিজের জাহাজ ছিল। তাছাড়া তিনি পণ্য চালানের জন্য ওলন্দাজ ও ইংরেজ জাহাজ ভাড়া করতেন। এই সকল তথ্য জানিয়েছে ইরফান হাবিব মধ্যযুগের ভারত গ্রন্থে।
জাহানারার জীবনের খণ্ডচিত্র
নূরজাহানের মতোই জাহানারারও নিজস্ব পাঠাগার ছিল। একইভাবে তিনিও প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন দান-সদকায়। বিশেষত দরিদ্র-পীড়িতদের আর বিয়ে-শাদীর প্রয়োজনে তিনি মুক্ত হস্তে দান করতেন। তিনিও সুন্দর সুন্দর ভবন নির্মাণ করেন। তাঁর নির্মিত অপূর্ব সুন্দর দিল্লির সরাইখানার স্থাপত্যশৈলী ও সৌন্দর্য দেখে বিখ্যাত পর্যটক বার্নিয়ার প্যারিসেও অনুরূপ সুন্দর ভবনের প্রতিষ্ঠা কামনা করেন। পিতার বিশ্বখ্যাত তাজমহল নির্মাণের নেপথ্যে ছিল জাহানারার প্রণোদনা। শাজাহান বলতেন, তিনি মমতাজের কল্যাণময়ী প্রতিরূপ কন্যা জাহানারার মধ্যে দেখতে পান।
নূরজাহানের মতোই জাহানারাও মোগল প্রশাসনের অন্যতম মন্ত্রণাদাত্রী এবং ছিলেন সম্রাটের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন পরামর্শক। ১৬৫৮ সালে শাজাহান পীড়িত হলে মোগল ক্ষমতা লাভের ভ্রাতৃবিরোধ তুঙ্গে উঠে এবং সেই প্রায়-গৃহযুদ্ধাবস্থায় জাহানারার বিশেষ ভূমিকা উল্লেখ করার বিষয়। জাহানারা ভাগ্যাহত-উদারমতি দারাশিকোর পক্ষপাতী ছিলেন যদিও তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে রক্তপাতের ঘোরতর বিরোধী। সেকালের প্রথানুযায়ী দারার সঙ্গে তাঁর মাতা-পুত্রের সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং দারাশিকোর বিবাহে যে ত্রিশ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়, তার সিংহ ভাগ, অর্থাৎ চোদ্দ লক্ষ টাকা জাহানারা আপন তহবিল থেকে প্রদান করেন। দারার প্রতি আকর্ষণ তাঁর মতে দারার হৃদয়ের বিশালতা ও আত্মার মহত্ত্বের জন্য। আওরঙ্গজেব সম্পর্কে তিনি বলতেন, তাঁর কাছে দুনিয়া নীতিবাক্যে আবর্তিত।
ক্ষমতার যুদ্ধে অবশেষে যদিও দারা পরাজিত, পলাতক, ধৃত, বন্দী ও পরিশেষে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং পিতা শাজাহান আগ্রা দুর্গে বিজয়ী পুত্র আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী হন, তথাপি জাহানারা পক্ষ-ত্যাগ করেন নি। দুর্লভ পিতৃস্নেহের ঐতিহাসিক ও মানবিক দৃষ্টান্ত রেখে জাহানারা স্বেচ্ছায় পিতার সঙ্গে কারাবাস করেন। তিনি সুদীর্ঘ নয় বৎসর পিতার মৃত্যু পর্যন্ত বন্দী জীবন-যাপন করেন এবং পিতার কারা-যন্ত্রণা লাঘব করতে চেষ্টা করেন। এহেন ট্র্যাজিক পরিস্থিতিতে পিতা শাজাহান কন্যা জাহানারার কোলে মাথা রেখে তাজমহলের দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি রেখে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন, যে সকরুণ দৃশ্য কল্পনেত্রে এঁকেছেন শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত শাজাহানের মৃত্যু চিত্রকলায়। পিতার প্রতি কন্যার এই দায়িত্বজ্ঞান ও কর্তব্যবোধের নজীর বিশ্ব-ইতিহাসে বিরল। অনেকেই জাহানারাকে স্বীয় অবদানের জন্য শেক্সপিয়র বর্ণিত কিং লিয়ারের কন্যা কর্ডেলিয়ার সঙ্গে তুলনার করেন।
জাহানারা ছিলেন সুকবি। স্বরচিত কাব্যশ্লোক তাঁর সমাধিতে খোদিত। দিল্লির বিখ্যাত সর্বজনশ্রদ্ধেয় সূফীসাধক নিযামুদ্দিন আউলিয়ার ভক্ত ছিলেন তিনি এবং তাঁর মাযারে প্রচুর অর্থ অনুদান প্রদান করেন। এমন কি, জাহানারা অন্তিম ইচ্ছানুসারে এই মহান আউলিয়ার সমাধি পাশে মুক্ত আকাশের নীচে চিরনিদ্রায় শায়িতা রয়েছেন, যে কবরের উপর কোন সৌধ নেই। সমাধি ফলকে খোদিত রয়েছে বিখ্যাত স্বরচিত শ্লোক: “বেগায়র সবজা না পোশদ বসে মাযারে মারা/ কে কবর পোশে গরিবান গিয়াহ বসন্ত। ” দৃষ্টিপাত গ্রন্থে যাযাবর যার অনুবাদ করেছেন: “একমাত্র ঘাস ছাড়া আর যেন কিছু না থাকে আমার সমাধির উপরে/ আমার মত দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন। ”
কী অপূর্ব আত্মত্যাগ আর সংযমবোধ মিশে আছে জাহানারার জীবন ও মরনে! যিনি নেপথ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও সৌন্দর্যম-িত সমাধিসৌধ তাজমহলের নির্মাণ-উৎসাহ প্রদানকারী এবং যিনি নিজেও স্বীয় সমাধিকে গৌরবময় স্থাপত্যে অভিষিক্ত করার মতো অঢেল সম্পদের অধিকারী ছিলেন, তিনি কি-না সাদামাটা কবরের মাধ্যমে নিজের শেষ চিহ্নটুকুকে আবেগময় মাধুর্যে সিক্ত করেছেন! তাঁর মনের গভীরে ছিল ত্যাগের এক অনুপম অভিব্যক্তি, যা মৃত্যুতে প্রকাশিত হয়।
জাহানারা সম্পর্কে সমকালীন বিখ্যাত সূফীসাধক মোল্লা শাহ বলেছেন: ইনি একজন অসাধারণ মহিলা। রহস্যবিদ্যা গভীরভাবে আয়ত্ত করেছেন। ইনি আমার প্রতিনিধি হওয়ার যোগ্য। বস্তুতপক্ষে, জাহানারা ধর্মকে নিছক প্রাতিষ্ঠানিক আনুষ্ঠানিকতায় নয়, দেখেছেন জীবনের বৃহত্তর নৈতিকতারূপে।
************
সুকবি জাহানারা ফারসি ভাষায় কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচনা করেছেন। অনেকগুলো নানা কারণে হারিয়ে গেলেও খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি এবং অন্য সূফী-সাধকদের জীবনীসমূহ সংরক্ষিত রয়েছে। জাহানারা বলেছেন, খাজা বাবা হিন্দুস্তানে আগমন করেছিলেন ‘মাধুর্য’ ও ‘আলোক’ বিস্তার করতে। জাহানারা খাজা বাবার একটি বিখ্যাত উক্তির অনুসারী ছিলেন, যেখানে খাজা সাহেব বলছেন: “উচ্চস্তরের আল্লাহর আরাধনা হলো জনগণের দুর্গতি দূর করা, অসহায়ের প্রয়োজন মেটানো ও ক্ষুধার্তদের আহার দেওয়া …আরো হতে হবে মানবকে নদীর মতো উদার, সূর্যের মতো অনুরক্ত ও ধরিত্রীর মতো অতিথিপরায়ণ। ” জাহানারা রচিত একটি খ-িত আত্মজীবনী পাওয়া যায়, যা মোগল ঐতিহ্যের পরিচায়ক। সেই আত্মজীবনী বেভারেজ ইংরেজিতে এবং মাখন লাল রায় চৌধুরী বাংলায় অনুবাদ করেছেন।
এক সঙ্গীতশিল্পী রাজপুত যুবকের সঙ্গে প্রেমাবদ্ধ হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করে আত্মজীবনীতে জাহানারা আধুনিক ট্র্যাজিক নায়িকার মতো ব্যক্তিসত্ত্বার হাহাকার ও যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেছেন। পূর্ব-পুরুষ বাবরের জীবনস্মৃতি থেকে কয়েকটি উক্তি তাঁর আপন আত্মজীবনীতে প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই মর্মে: “আমি আজ সম্রাট বাবরের কথাগুলো স্মরণ করছি। আমার আপন আত্মার মতো বিশ্বস্ত কোন বন্ধু পাই নি। আমার নিজ অন্তর ব্যতিত আমি কোন নির্ভরযোগ্য স্থান পাই নি। ”
জাহানারার অবস্থান ছিলো দিল্লির সাংস্কৃতিক জীবনধারার প্রাণকেন্দ্রে। তিনি সঙ্গীতশিল্পীকে এবং উচ্চমানের কাব্য রচনার জন্য মুক্ত হস্তে উপহার দিতেন। এমন কি, আপন কণ্ঠ হতে মণি-মুক্তার মালা খুলে শিল্পীকে উপঢৌকন দিয়ে মোগল আভিজাত্য ও ঐতিহ্য পালন করতেন।
স্থাপত্য-নির্মাণেও জাহানারার অবদান অপরিসীম। তাজমহলের নেপথ্য-রূপকাররূপে তো বটেই, দিল্লির বেশ কয়েকটি সুরম্য বাগানবাড়ি এবং বিখ্যাত সরাইখানা তাঁর উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। আগ্রার বিশ্বখ্যাত জামে মসজিদটি তাঁর তৈরি। বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করে দিয়ে একটি মাদ্রাসাও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
জাহানারার অনেক ছোট-বড় স্থাপত্য নিদর্শন সিপাহি বিদ্রোহের বিজয়ের পর দুর্বৃত্ত ইংরেজ সরকার মোগল শাসন ধ্বংসের মতোই ধ্বংস করে দেয়। মৃত্যুকালে তিনি প্রভূত অস্থাবর সম্পত্তি ছাড়াও তৎকালের হিসাবে নগদ তিন কোটি টাকা রেখে যান, যার অধিকাংশই হযরত নিযামুদ্দিন আউলিয়ার মাযার শরীফে দান করে দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব ইসলামি বিধান মতে জাহানারার পরিত্যাক্ত সম্পত্তির এক-তৃতীয়াংশ ওয়াকফে কার্যকর করে বাকী সম্পদ রাজভা-ারে বাজেয়াপ্ত করেন।
জাহানারার বিত্তশালীতার একটি তুলনামূলক উদাহরণও পাওয়া যায়। ১৮৩২ সালে একজন আমেরিকান শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তির বাজার মূল্য ছিল দেড় মিলিয়ন ডলার, যার তখনকার বিনিময় হার ছিল পঁচাত্তর লক্ষ টাকা। আর জাহানারা রেখে যা নগদ তিন কোটি টাকা! এ হলো মোগল বৈভব আর ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পদশালীতার নমুনা।
জাহানারা তৎকালীন বিশ্বের ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করেন তাঁর সম্পদ, রূপ, গুণ ও যোগ্যতার জন্য। বিদেশি পর্যটকদের প্রায়-সকলেই তাঁর কথা উল্লেখ করেছেন, যদি সে বিবরণ কখনও কখনও পক্ষপাত ও কল্পনাপ্রসূত। তাভেনিয়ার বলেছেন, সম্রাট দুহিতা জাহানারা একটি স্বাধীন রাজ্য পরিচালনার ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন।
বিখ্যাত পর্যটক বার্নিয়ারের বিবরণ প্রণিধানযোগ্য। তিনি উল্লেখ করেন, শাজাহানের জ্যেষ্ঠা কন্যা বেগম সাহেবা অসাধারণ সুন্দরী ও গুণবতী ছিলেন। সম্রাট তাঁকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। এই কন্যার উপর শাজাহানের অগাধ বিশ্বাস ছিল এবং তিনি পিতার সমস্ত দায়িত্ব বহন করতেন। শাজাহান যা আহার করতেন তা তাঁর তত্ত্বাবধানে তৈরি করা হতো। অন্যের তৈরি খাদ্য তিনি কখনও খেতেন না। এইজন্য মোগল দরবারে সম্রাটের এই কন্যার প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল অসাধারণ। সম্রাটের সঙ্গে তিনি ছায়ার মতো থাকতেন, তাঁর আমোদ-প্রমোদ, হাসি-ঠাট্টায় যোগ দিতেন এবং কোন গুরুতর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় কন্যার মতামতের যথেষ্ট মূল্য দিতেন। বেগম সাহেবার ব্যক্তিগত ধনদৌলত প্রচুর ছিল। কারণ তিনি সম্রাটের কাছ থেকে মোটা ভাতা ও উপহার তো পেতেনই, আমির-ওমরাহ, আমলা, আমত্যরাও যাতে তাঁর নেক নজরে থাকতে পারেন, সেই আশায় সর্বদাই নানা রকমের উপহার-উপঢৌকন দিয়ে তাঁকে খৃুশী করার চেষ্টা করতেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো যে সম্রাটের সমর্থন ও প্রীতি লাভে সক্ষম হয়েছিলেন, তার প্রধান কারণ এই ভগিনীর সহানুভূতি। দারা সব সময় এই ভগিনীর মন যুগিয়ে চলতেন।
জাহানারা ব্যক্তিগতভাবে ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণের অংশ এবং মোগল বংশের ভাগ্যের নিয়ামকও বটে। কারণ জাহানারা একদা মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে অশেষ কষ্ট ভোগ করে যে ইংরেজ চিকিৎসকের মাধ্যমে আরোগ্য লাভ করেন, সে ইংরেজের বণিক বুদ্ধিই কালাক্রমে উপমহাদেশে ইংরেজ শাসনের পথ রচনা করে।
ঘটনাটি এ রকম: জাহানারার স্নেহভাজন ছিল এক বাঁদী। অর্তকিতে একদিন আগুন লাগাল বাঁদীর বসনে। সে আগুন নেভাতে গিয়ে শাহজাদী নিজে দগ্ধ হলেন সাংঘাতিকরূপে। রাজ্যের নানা জায়গা থেকে এলো বড় বড় হেকিম, কবিরাজ। দেওয়া হলো নানা রকমের চিকিৎসা। কিন্তু ফল হল না কিছুই। সম্রাটনন্দিনীর জীবন সংশয় দেখা দিল। বিচলিত শাজাহান অবশেষে ডেকে পাঠালেন বাণিজ্য বহরের এক সাহেব চিকিৎসককে। নাম তাঁর গ্যাবরিয়েল বাউটন। সুরাটের ইংরেজ কুঠির ডাক্তার তিনি। বাউটন বললেন, ঔষধ দিতে হলে রোগিনীকে চোখে দেখা চাই। শুনে পুরো রাজ-দরবার স্তম্ভিত এবং হতবাক হয়ে গেল। বলে কি বেয়াদপ! সম্রাট দুহিতার দিকে চোখ তুলে তাকানোর হিম্মৎ! অনেকে রুখে গেলেন চিকিৎসকের দিকে। চিকিৎসক অনঢ়। রোগি না দেখে ঔষধ দিতে পারবেন না, দিলেও আরোগ্যের গ্যারান্টি দেওয়া সম্ভব হবে না। রোগিকে ভালো মতো দেখে ঔষধ দিলে তিনি সুস্থতার আশা দিতে পারেন।
শেষ পর্যন্ত পিতৃস্নেহ জয়লাভ করলো সামাজিক প্রথার উপরে। শাজাহান সম্মত হলেন বাউটনের প্রস্তাবে। অল্পকালের মধ্যে আরোগ্য লাভ করলেন জাহানারা। তাঁর অনুরোধে সম্রাট চিকিৎসককে দিতে চাইলেন পুরস্কার: যা চাইবে, তা-ই পাবে। আভূমিনত কুর্নিশ করে বিচক্ষণ ডা. বাউটন বললেন, নিজের জন্য কিছু চাই না। কলকাতার ১৪০ মাইল দক্ষিণে বালাশোরে ইংরেজের কুঠি নির্মাণের জন্য প্রার্থনা করি এক টুকরো ভূমিখণ্ড আর ইংরেজকে দান করুন এদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার। পিতৃস্নেহ আবারও কূট কৌশলের কাছে পরাজিত হলো। শাজাহান বাউটনের প্রার্থনা মঞ্জুর করলেন কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া বুঝতে পারলেন না।
বাউটনের মতো স্বজাতি হিতৈষণার এতবড় দৃষ্টান্ত আর একটিমাত্র আছে আধুনিক ইতিহাসে। সেটি ইহুদি বৈজ্ঞানিক ড. কাইম ভাইজম্যানের। ১৯১৬ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্কটকালে ইংল্যান্ডে বিস্ফোরক উৎপাদনের অপরিহার্য উপাদান অ্যাসিটোনের তীব্র অভাব পরিলক্ষিত হলে কৃত্রিম অ্যাসিটোন তৈরি ভার নিলেন ম্যাঞ্চেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক। প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ হুকুম দিলেন, অধ্যাপক! সমগ্র ব্রিটেনের ভাগ্য নির্ভর করছে তোমার সফলতা আর বিফলতার উপরেই। আমি চাই তাড়াতাড়ি কাজ, দ্রুত সফলতা। হুকুম মেনে নিলেন অধ্যাপক। শুরু করলেন দিবারাত্রির অবিশ্রান্ত পরিশ্রম। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আবিষ্কার করে ফেললেন কৃত্রিম অ্যাসিটোন। সম্ভাব্য পরাজয়ের হাত থেকে ব্রিটেনকে রক্ষা করলেন ইহুদি বিজ্ঞানী অধ্যাপক ভাইজম্যান। কৃতজ্ঞ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ তাঁকে ডেকে দিতে চাইলেন ব্যক্তিগত পুরস্কার। সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করলেন ড. ভাইজম্যান। বিস্মিত প্রধানমন্ত্রী জানতে চাইলেন, তাহলে কি চাই? ভাইজম্যান বললেন, কিছু নয়। একটি মাত্র আরজি আছে আমার। আমার স্বজাতির জন্য চাই নির্দিষ্ট একটি দেশ। ইহুদিদের ন্যাশনাল হোম। কিছুদিন পর বেলফোর ঘোষণায় ইহুদিদের জন্য প্যালেস্টাইনের বুকে নির্দিষ্ট হলো জাতীয় বাসস্থান, যা আজকে ইসরায়েলের ভ্রুণ।
জাহানারার অনুগ্রহে ইংরেজরা বাণিজ্য ও ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করলো ভারতবর্ষে এবং উপনিবেশের ভিত্তি স্থাপন করলো সকলের অলক্ষ্যে। সেই জাহানারার চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করে ইতিহাসও রচনা করেছে ইংরেজরা। সে যাই হোক, জাহানারার আরোগ্য লাভের আনন্দে সম্রাট আটদিনব্যাপী নৃত্য-গীত, উৎসব ও ভোজের আয়োজন করেন। তারপর আরও অনেক দিন বেঁচে ছিলেন জাহানারা এবং পবিত্র রমযানের এক পুণ্য তিথিতে ঊনসত্তর বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নূরজাহান, জাহানারার সঙ্গে চলে আসে আওরঙ্গজেব-দুহিতা জেবুন্নেসার নাম। তেজস্বিনী-চিরকুমারী এই মোগল রমণী ছিলেন বিখ্যাত কবি। জেব-উ-মুনশোয়া কাব্য রসিকদের নজর কেড়েছে সব সময়ই। রাজনীতি ও চক্রান্ত থেকে বহু দূরে অবস্থান করে তিনি সুকুমার কলার আরাধনায় জীবন অতিবাহিত করেন। তথাপি সাম্রাজ্যের ঝড়-ঝাপ্টা তাঁকেও স্পর্শ করেছিল। তিনি জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটান মোগল কারাগারে। মোগল সূর্য অস্তাচলে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি নীরব স্বাক্ষীর মতো অবলোকন করেন অবক্ষয় আর ধ্বংসের আসন্ন পদধ্বনি।
এক দিকে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ সজ্জিত রয়েছে শত-সহস্র মোগল নির্মাণ ও স্থাপত্যের অলঙ্কারে, যার নেপথ্যের অন্যতম রূপকার ছিলেন যে সকল নারী, তাঁদের সমাধিক্ষেত্র অতি সাধারণভাবে লুটিয়ে রয়েছে মাটির সঙ্গে। কেবল দুর্বাদল ছেয়ে আছে সেইসব নিরলঙ্কার সমাধিসমূহ। সেই পবিত্র স্মৃতিচিহ্নে প্রত্যহ নিশীতে নির্মল নীল আকাশ থেকে সঞ্চিত হয় বিন্দু বিন্দু শিশির, প্রভাতে স্পর্শ করে তরুণ অরুণের প্রথম আলো, সন্ধ্যায় ছড়িয়ে পড়ে গোধূলির মায়াময় স্বর্ণাভা। শতবর্ষ প্রাচীন মোগল রমণীকূলের সমাধি থেকে আজও উৎসারিত হয় কলা ও সুকুমার বৃত্তির অনিন্দ্য লালিত্য। আর ভক্তিনত ত্যাগাকুল হৃদয়ের নম্র-লাজুক ভাব—
Leave a Reply