বাংলাদেশ নিয়ে গত কিছুদিন ধরে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গতকাল বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত একটি অনুষ্ঠানে বলেছেন যে, কিছু পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার মান্টিটস্কি এই মন্তব্য করলেন এমন একটা সময় যখন বাংলাদেশের নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে এবং এই নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি রহস্যময় নীরবতা পালন করছে। আর অ্যালেকজান্ডার তার বক্তব্যে এটিও বলেছেন যে, বিদেশিদের সহায়তা ছাড়াই বাংলাদেশের সরকার যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের সক্ষম বলেই তিনি বিশ্বাস করেন এবং তার দেশ সেটাই মনে করেন। তার এই বক্তব্য যখন দেওয়া হচ্ছিল ঠিক তার কিছুক্ষণ আগেই বড় রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কৌশলগত যোগাযোগ সমন্বয়ক জন কিরবি। তিনি বলেছেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার করা অভিযোগ পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং বানোয়াট। তিনি এক ব্রিফিংয়ে এই বক্তব্য রাখেন।
জন কিরবি বলেন যে, এটা পুরোপুরি মিথ্যা। রুশরা জানে এটা মিথ্যা। এটা রাশিয়ার নিখাত প্রচারণা ছাড়া অন্য কিছু নয়। করবি অবশ্য এটাও বলেছেন যে, বাংলাদেশের জনগণ যা চায় তারাও তা চান। আর তা হলো অবাধ, সুষ্ঠু ও নির্বাচন। এই লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার দল কাজ করে যাচ্ছিল। তারা একই ভাবে বাংলাদেশের সুশীল সমাজ, বিরোধী দল, সরকার সহ বাংলাদেশের সব স্তরের মানুষের সঙ্গেই কাজ করে যাবেন বলে করবি তার প্রেস ব্রিফিংয়ে উল্লেখ করেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাশিয়ার বাংলাদেশ নিয়ে দ্বন্দ্ব নতুন নয়। গত কয়েক মাস ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে রাশিয়া কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে তারা অতি আগ্রহী হয়ে বক্তব্য রাখছে। বিশেষ করে পিটার হাস বাংলাদেশের বিরোধী দলের সঙ্গে যোগসাজস করেছেন এমন অভিযোগ রাশিয়ার পক্ষ থেকে করা হয়েছে। করবি যেটি আনুষ্ঠানিকভাবে নাকচ করলেন। তবে এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার এই বক্তব্য খণ্ডন করেছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে যে, বিশ্বে যখন রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর মুখোমুখি, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যখন পুরো বিশ্ব বিভক্ত, তখন বাংলাদেশ ইস্যুতে রাশিয়া কেন সরব হল? এর আগে রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে এমন সরব ছিল না। বিশেষ করে দু বছর আগে থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন এবং গণতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তা বলেছে তৎপরতা দেখিয়েছে। একাধিক মার্কিন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন এবং আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও তারা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন। এছাড়াও বাংলাদেশে সুশাসন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়েও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কথাবার্তা বলা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ দেওয়া হয়েছে। এই সময়গুলোতে রাশিয়ার তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করেই গত চার মাস আগে থেকে রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে সরব অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং বাংলাদেশ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে তারা ‘বাড়াবাড়ি’ বলে মনে করছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে, এটি কৌশলগত অবস্থান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কোণঠাসা হয়ে পড়া রাশিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে যেখানে পারছে সেখানেই বিতর্কিত এবং সমালোচিত করার কৌশল নিয়ে কাজ করছে এবং সে কারণেই বাংলাদেশ ইস্যুটিকে তারা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সামনে নিয়ে এসেছে। তবে এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে তা নিয়ে কূটনৈতিক মহল বিভক্ত। কোনো কোনো কূটনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন যে, এর ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সজাগ সচেতন থাকবে। তারা বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে মাথায় রাখবে যে রাশিয়া সব বিষয়গুলো নিরীক্ষা করছে এবং পর্যবেক্ষণ করছে। কিন্তু অনেক কূটনৈতিক বিশ্লেষক এই মতের সাথে একমত নয়। বরং তারা বলেছে যে, রাশিয়ার এই অতি আগ্রহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশের ব্যাপারে আরও আগ্রহী করে তুলবে। বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক তারা ভালোভাবে নেবেন না। ফলে বাংলাদেশের ওপর অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করতে পারে। এখন দেখার বিষয় যে এই দ্বন্দ্বের পরিণতি বাংলাদেশে পরিস্থিতি কোনদিকে নিয়ে যায়।