কায়রো থেকে বিশ মাইল দক্ষিণে, প্রাচীন মিশরের একসময়ের রাজধানী মেম্ফিসের উপকণ্ঠে সাকারা নেক্রোপোলিস (Saqqara), সহজভাবে বললে প্রাচীন মিশরীয়দের গোরস্থান। নীলনদের পশ্চিম তীরের এই নেক্রোপোলিসেই আছে প্রথম মিশরীয় পিরামিড, ফারাও জোসেরের ধাপ পিরামিড (Step Pyramid)। খ্রিস্টের জন্মের আরো অন্তত দুই হাজার সাতশো বছর আগে এর নির্মাণ।
নেক্রোপোলিসে পিরামিড ব্যতীত অন্যান্য স্থাপনাও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রাচীন বহু সমাধি আর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ। প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে এ এক সোনার খনি, কারণ প্রায়শই নতুন কিছু না কিছু খুঁজে পাচ্ছেন তারা। সেই ধারায় প্রায় এক বছর খননকাজের পর এই বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশ করা হয় বেশ বড় একটি তালিকার। এর অন্যতম প্রায় সাড়ে চার হাজার বছরের পুরাতন একটি মমি।
নেক্রোপোলিসের যে জায়গায় মমিটি পাওয়া গেছে তার নাম গ্রেট এনক্লোজার (Great Enclosure/ Gisrel-Mudir)। আমাদের জানা প্রাচীন মিশরের পাথরের স্থাপনাগুলোর মধ্যে এটিই সম্ভবত সবচেয়ে পুরনো। এখানকার সমাধিগুলো প্রাচীন মিশরের পঞ্চম ও ষষ্ঠ রাজবংশের সমসাময়িক। এদের সময় ধরা হয় আনুমানিক পঞ্চবিংশ থেকে একবিংশ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে। এখানে কাজ করছিলেন মিশরের নামকরা প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রাক্তন পুরাকীর্তি মন্ত্রী জাহি হাওয়াস ও তার সহকর্মীরা। এই আবিষ্কারের কৃতিত্ব তাদেরই।
তবে হাওয়াসের জন্য বিস্ময় হয়ে আসে সার্কোফেগাসের ভেতরের জিনিস। আপাদমস্তক সোনায় মোড়ানো প্রায় অবিকৃত এক প্রাচীন মিশরিয়কে দেখতে পান তারা। পরীক্ষানিরিক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন- এর বয়স চার হাজার তিনশো বছরের বেশি বৈ কম নয়।
কিন্তু মমির পরিচয় কী? কোনো ফারাও তো নন তিনি, তাহলে কে? বলা হচ্ছে তার নাম জেড শেপশ, অথবা হেকাশেপস (Djed Sepsh/ Hekashepes)। নিজের সময়ে মহা সম্পদশালী ছিলেন তিনি, কিন্তু মারা যান মাত্র ৩৫ বছরেই। পয়সাওয়ালা লোকদের মমি করার প্রথা তখন সবে চালু হয়েছে। তবে এত ধনবান কাউকে তো আর যেমন তেমনভাবে মমি করা যায় না! তাই সোনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয় হেকাশেপসের মমি। এরপর জাঁকজমকের সাথে সার্কোফেগাস নামিয়ে দেয়া হয় গর্তের ভেতর।
হেকাশেপসের বেশ কিছু ছবি অনলাইনে দেয়া হয়। সেখান থেকে দেখা যায় অন্যান্য মমির মতো ব্যান্ডেজ না পেঁচিয়ে ঢিলেঢালা আলখাল্লা জাতীয় কিছু পরানো হয়েছে তাকে। গলায় জড়ানো নেকলেস আর কোমরে বেল্ট। ইতালির এনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্রান্সেসকো তিরাদ্রিতির (Francesco Tiradritti) ভাষ্যে- মৃত্যুর পরও যাতে জীবিতের মতো দেখা যায় এজন্যই হেকাশেপসের আত্মীয়স্বজন এই রাস্তা বেছে নেয়। এটা সেই সময়ের মিশরীয় ধর্মবিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে। ফলে প্রাচীন মিশর সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান আরো সমৃদ্ধ করতে পারে হেকাশেপস।
প্রাথমিকভাবে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমে হেকাশেপসকে প্রাচীনতম মিশরীয় মমি বলে প্রচার করা হয়। তবে জাহি হাওয়াস দ্রুত সেটা সংশোধন করে দেন। তার মতে- হেকাশেপস স্বর্ণমোড়ানো মমির মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন, তবে প্রাচীনতম মমি নয়। বর্তমান লাক্সর শহর থেকে ২৫ মাইল দূরে পাওয়া গেছে অন্তত ৫,০০০ বছরের পুরনো কিছু মমি, এগুলোই এখন পর্যন্ত প্রাচীনতম। তবে এর কোনোটিই হেকাশেপসের মতো স্বর্ণখচিত নয়।
বলে রাখা ভালো- হেকাশেপসই কিন্তু এক বছরের খননকাজের একমাত্র ফলাফল নয়। নতুন কয়েকটি সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর একটির বাসিন্দা খুনুমজেদেফ নামে এক পুরোহিত (Khnumdjedef)। সমাধির গায়ের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি পঞ্চম রাজবংশের শেষ রাজা উনাসের কর্মচারী ছিলেন। মেরি নামে আরেক রাজকর্মচারীর কবরও খোলা হয়েছে, যিনি ফারাওয়ের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন। এর বাইরে মূর্তি, তাবিজ বা অ্যামুলেট এমন নানা জিনিস পাওয়া গেছে।
প্রাচীন মিশর নিয়ে আমাদের আগ্রহ অসীম। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে দৃশ্যমান অনেক জায়গাতেও নতুন নতুন আবিষ্কার করা হচ্ছে। আর চোখের আড়ালে কত কী যে রয়ে গেছে বলা মুশকিল! তবে মিশরে আরো বড় বড় আবিষ্কার নিশ্চয় হবে, আমরাও জানতে পারবো ইতিহাসের অজানা কথা।
Leave a Reply